মা সারদাদেবী

যাঁর ছবি-প্রতিমার দিকে তাকালে কৃপাময়ী মা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না ; সেই ঠাকুর রামকৃষ্ণের শক্তি এবং সাধনসঙ্গী মা সারদাদেবীর আজ পবিত্র জন্মতিথি। জন্মতিথিতে মায়ের শ্রীপাদপদ্মে সহস্র প্রণাম।
১৮৫৩ সালের ২২ ডিসেম্বর, বাংলা ১২৬০ সনের ৮ পৌষ, অগ্রহায়ণ মাসের কৃষ্ণা সপ্তমী তিথিতে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার অন্তর্গত প্রত্যন্ত গ্রাম জয়রামবাটীর এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে সারদা মায়ের জন্ম হয়। তাঁর পিতা রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও মাতা শ্যামাসুন্দরী দেবী অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ছিলেন। সারদা দেবীর পিতৃকূল মুখোপাধ্যায় বংশ পুরুষানুক্রমে ভগবান শ্রীরামের উপাসক ছিলেন। সারদা দেবী ছিলেন তাঁদের জ্যেষ্ঠা কন্যা তথা প্রথম সন্তান। জন্মের পর প্রথমে সারদা দেবীর নাম রাখা হয়েছিল "ক্ষেমঙ্করী"। পরে "ক্ষেমঙ্করী" নামটি পালটে "সারদামণি" রাখা হয়। রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় কৃষিকাজ ও পুরোহিতবৃত্তি করে জীবিকানির্বাহ করতেন এবং তিন ভাইকে প্রতিপালন করতেন। দরিদ্র হলেও রামচন্দ্র ছিলেন পরোপকারী ও দানশীল ব্যক্তি। কথিত আছে, সারদা দেবীর জন্মের আগে রামচন্দ্র ও শ্যামাসুন্দরী উভয়েই অনেক দিব্যদর্শন করেছিলেন। সারদা মায়ের জন্মের পর রামচন্দ্র ও শ্যামাসুন্দরীর কাদম্বিনী নামে এক কন্যা এবং প্রসন্নকুমার, উমেশচন্দ্র, কালীকুমার, বরদাপ্রসাদ ও অভয়চরণ নামে পাঁচ পুত্রের জন্ম হয়।
বাল্যকালে সাধারণ গ্রামবাসী বাঙালি মেয়েদের মতো সারদা দেবীর জীবনও ছিল অত্যন্ত সরল ও সাদাসিধে। ঘরের সাধারণ কাজকর্মের পাশাপাশি ছেলেবেলায় তিনি তাঁর ভাইদের দেখাশোনা করতেন, জলে নেমে পোষা গোরুদের আহারের জন্য ঘাস কাটতেন, ধানখেতে ক্ষেতমজুরদের জন্য মুড়ি নিয়ে যেতেন, প্রয়োজনে ধান কুড়ানোর কাজও করেছেন। সারদাদেবীর প্রথাগত বিদ্যালয়ের শিক্ষা একেবারেই ছিল না। ছেলেবেলায় মাঝে মাঝে ভাইদের সঙ্গে পাঠশালায় যেতেন। তখন তাঁর কিছু অক্ষরজ্ঞান হয়েছিল। পরবর্তী জীবনে কামারপুকুরে শ্রীরামকৃষ্ণের ভ্রাতুষ্পুত্রী লক্ষ্মী দেবী ও শ্যামপুকুরে একটি মেয়ের কাছে ভাল করে লেখাপড়া করা শেখেন। ছেলেবেলায় গ্রামে আয়োজিত যাত্রা ও কথকতার আসর থেকেও অনেক পৌরাণিক আখ্যান ও শ্লোক শিখেছিলেন। ছেলেবেলায় পুতুলখেলার সময় লক্ষ্মী ও কালীর মূর্তি গড়ে খেলাচ্ছলে পূজা করতেন। সেই সময় থেকেই তাঁর বিবিধ দিব্যদর্শনের অভিজ্ঞতা হত। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সাথে তাঁর বিবাহ হয়। এ বিবাহই তাকে এক কিংবদন্তী দিব্য মাতৃপ্রতিমায় পরিণত করে।
১৯২০ সালের ২০ জুলাই ৬৬ বছর বয়সে তিনি মহাসমাধী লাভ করেন পশ্চিমবাংলার কলকাতার
বাগবাজার মায়ের বাড়িতে।
মায়ের জন্মতিথিতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি সরূপ তার অসংখ্য বাণী হতে আটটি বাণী নিচে তুলে দিচ্ছি ; আশাকরি আপনাদের জীবন চলাতে এ কথাগুলো কাজে লাগবে।
১. আমি সত্যিকারের মা; গুরুপত্নী নয়, পাতানো মা নয়, কথার কথা মা নয় – সত্য জননী।
২.যেমন ফুল নাড়তে-চাড়তে ঘ্রাণ বের হয়, চন্দন ঘষতে ঘষতে গন্ধ বের হয়, তেমনি ভগবত্তত্ত্বের আলোচনা করতে করতে তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয়।
৩. ভালবাসায় সবকিছু হয়, জোর করে কায়দায় ফেলে কাউকে দিয়ে কিছু করানো যায় না।
৪.সৎসঙ্গে মেশো, ভাল হতে চেষ্টা কর, ক্রমে সব হবে।
৫.কাজ করা চাই বইকি, কর্ম করতে করতে কর্মের বন্ধন কেটে যায়, তবে নিষ্কাম ভাব আসে। একদণ্ডও কাজ ছেড়ে থাকা উচিত নয়।
৬. মনটাকে বসিয়ে আলগা না দিয়ে কাজ করা ঢের ভাল। মন আলগা হলেই যত গোল বাধায়।
৭.ভাঙতে সবাই পারে, গড়তে পারে কজনে? নিন্দা ঠাট্টা করতে পারে সব্বাই, কিন্তু কি করে যে তাকে ভাল করতে হবে, তা বলতে পারে কজনে?
৮.যারা এসেছে, যারা আসেনি, যারা আসবে, আমার সকল সন্তানকে জানিয়ে দিও, মা, আমার ভালবাসা, আমার আশীর্বাদ সকলের ওপর আছে।

0 comments:
Post a Comment